আত্মহত্যা একটি মৌলিক অধিকার

লিখেছেন লিখেছেন মোঃ মোরশেদুল আলম আরিফ ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ০৮:০৭:৩৫ রাত

একটা মানুষ কিভাবে মরবে, এটা নিতান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র সেখানে নাক গলানোর কে? প্রত্যেকটা মানুষই একেকটা রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রকে যখন আরেকটা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, তখন সেটা হয় অমানবিক এবং স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। তাছাড়া আত্মহত্যা শুধু ব্যক্তি স্বাধীনতা নয়, এটা মানুষের মৌলিক অধিকার, একটি নাগরিক অধিকার !

আত্মহত্যার বিপক্ষে যুক্তি হিসেবে যে কথাগুলো বলা হয় –

যে জীবন তোমার সৃষ্ট নয়, সেই জীবন শেষ করার অধিকারও তোমার নেই।

বেঁচে থাকাটা শুধু নিজের জন্য না। সমাজ ও পরিবারের দায় এড়িয়ে স্বেচ্ছায় মৃত্যু কাপুরুষতা এবং অপরাধ।

ধর্মে আত্মহত্যা মহাপাপ।

আত্মহত্যা কোন সমাধান না।

আত্মহত্যার সপক্ষে কিছু কথা

১. আমি একটা মেয়েকে চিনি, যার জন্মের সময় তার মা মারা যায়। মেয়েটির বড় হয়ে ওঠাটা আমি অনুভব করার চেষ্টা করি। মেয়েটা কোন দিন তার মায়ের হাতে ভাত খাইনি। খাওয়ার পর মায়ের আঁচলে মুখ মুছেনি। মায়ের মততা-শাসন কি, সেটা সে জানেনা। পুরো পৃথিবীর মালিকানা দিলেও এই মেয়েটা তার শৈশবের মায়ের আদর ফেরত পাবে না। এটা একটা ক্ষুদ্র ব্যাপার মাত্র। এই কারণে কেউ আত্মহত্যা করে না।

“যে জীবন তোমার সৃষ্ট নয়, সেই জীবন শেষ করার অধিকারও তোমার নেই” – এজন্যে এই যুক্তি আত্মহত্যার বিপক্ষে ধোপে টেকে না। ব্যাপারটা এরকম, জন্মাইছো যখন তখন ধুকেধুকে মরা পর্যন্ত অপেক্ষা করো। খুবই হাস্যকর এবং অযৌক্তিক একটি দাবী। জন্মের পর থেকে মানুষের একা একা বাঁচতে হয়। তিনদিন না খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকলেও কেউ ডেকে বলবে না, ‘আসো বাবা আমাদের ঘরে আজকে শিমের বিচি দিয়ে মুরগির মাংস রান্না হইছে, খেয়ে যাও।’ আবার এরা বলবে, জন্ম তোমার হাতে নেই, তাই নিজের মত মরতেও পারবে না। কি দারুণ কথা ! যাপিত জীবনের যন্ত্রনা একা সহ্য করতে হবে। কেউ ভাগ নেবে না। যাদের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছি তারাও নেবে না। সব নিজেকে নিতে হবে। শুধু নিজের মত করে মরতে গেলেই দাবী নিয়ে আসবে, তুমি নিজের ইচ্ছামত মরতে পারবে না…

২. বেসরকারী এক সমীক্ষায় জানা যায়, ৪০ ভাগ মানুষ আত্মহত্যা করে মানসিক অবসাদে ভুগে। আর ৩০ ভাগ আত্মহত্যা করে একাকীত্বের কারণে। ভাবা যায়? এত মানুষের ভিড়ে ৩০ ভাগ মানুষ আত্মহত্যা করছে শুধুমাত্র একাকীত্বের কারণে !

‘বেঁচে থাকাটা শুধু নিজের জন্য না। সমাজ-পরিবারের দায় এড়িয়ে সেচ্ছা মৃত্যু কাপুরুষতা এবং অপরাধ’ – এই বুলি যারা আওড়ায়, তাদের পাশের মানুষগুলোই যখন একাকীত্বের কারণে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তখন আত্মহত্যার মৃত্যুকে কাপুরুষতা বলে নিজেদের দায় এড়িয়ে নিচ্ছে এরা। আত্মহত্যা মানে তো নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। কোনভাবেই কোনকিছু হচ্ছে না। স্বপ্ন গুলো ফিকে হতে হতে অদৃশ্য হয়ে গেছে। কিছু মানুষ তো শুধু বেঁচে থাকে স্বপ্ন পুরণের আশা নিয়ে। যখন সে বুঝতে পারে তার স্বপ্ন পুরণের কোন আশাই নেই, কিংবা নতুনভাবে বেঁচে থাকতে দারুণ কিছু দরকার। কোনভাবেই এই দারুণ কিছুর নাগাল পাওয়া সম্ভব না। যার জন্য এই বেঁচে থাকাটাই যেনো হয়ে ওঠে মৃত্যুর চেয়ে কষ্টকর।

অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, আত্মহত্যা মানে ভীরুতা। মোক্ষম উল্টো চালে চার্লস কোল্টন বলেছেন, কখনো কখনো আত্মহত্যা না করাটাই ভীরুতা…

৩. রেল লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে কেউ একজন ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে, যে কিনা মৃত্যু থেকে মাত্র এক পা দূরে ! আপনি যদি ভেবে থাকেন, সে মৃত্যুর আগে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্বর্গ-নরক নিয়ে ভেবে রোমাঞ্চিত হচ্ছে, তাহলে আত্মহত্যা আপনার মত স্বপ্ন প্রবণ মানুষদের জন্য না। আত্মহত্যা একমাত্র তাদের জন্য যারা অনেক সমস্যার সহজ সমাধান হিসেবে আত্মহত্যাকে দেখে…

৪. ‘আত্মহত্যা কোন সমাধান না’ – তো সমাধানটা কিসে? শুধুমাত্র বেঁচে থাকাটাই সমাধান? যে জীবনের ভার বইতে বইতে ক্লান্তিতে আর অবসাদে মগজ গলে পঁচে যাচ্ছে। সেই পঁচে যাওয়া মগজ নিয়ে শুধুমাত্র নিঃশ্বাস নেওয়াটাকে যদি বেঁচে থাকা বলা হয়, তাহলে এই বেঁচে থাকাটা সবার জন্য নাহ। যারা আত্মহত্যা করে, তারা এতটা কাপুরুষ না যে শুধু নিঃশ্বাস নিতেই বেঁচে থাকবে…

আত্মহত্যার স্বপক্ষে যুক্তি সমূহ

একজন ব্যক্তিকে জীবন ও আত্মহত্যার মধ্যে বেছে নিতে দেয়ার স্বপক্ষে কিছু যুক্তি আছে। আত্মহত্যাকে ব্যক্তির ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া উচিত বলে যারা যুক্তি দেখান, তাদের মতে আত্মহত্যা সবসময় অযৌক্তিক নয়, কখনো কখনো বাস্তব সমস্যার সঠিক সমাধান। যেখানে বিকল্প সকল উপায় আত্মহত্যার চেয়ে খারাপ বলে মনে হবে, তখন আত্মহত্যা একটি বৈধ কাজ।

আদর্শবাদ : কিছু চিন্তাবিদের আত্মহত্যার প্রতি সমর্থনপুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী ছিল। গোথ এবং স্কোপেনহাওয়ার আত্মহত্যাকে জীবনের সবচেয়ে বড় স্বস্তি হিসেবে দেখেছেন। স্কোপেনহাওয়ার এর মতে, ‘আত্মহত্যাকে তারা ভীরুতাপূর্ণ কাজ বলে জ্ঞান দান করে, তারা বলে আত্মহত্যা ভুল কাজ; অথচ পৃথিবীতে মানুষের নিজের জীবনই তার জন্য সবচেয়ে অনাক্রম্য ব্যাপার’ !

স্কোপেনহাওয়ার আত্মহত্যাকে অনৈতিক বলে মনে করেন না। বরং তিনি আত্মহত্যাকে একজন ব্যক্তির অধিকার বলে মনে করেন। আত্মহত্যার সমর্থনে চমৎকার একটি রূপক ব্যবহার করেছেন স্কোপেনহাওয়ার। আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যু হওয়াকে তিনি তুলনা করেছেন দুঃস্বপ্ন দেখতে থাকা একজন ঘুমন্ত মানুষের ঘুম ভেঙ্গে বাস্তবে ফেরার সাথে !

স্বাধীনতাবাদ : স্বাধীনতাবাদ দাবী করে যে, মানুষের জীবন শুধু তারই, দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির কোনো অধিকার নেই কোন প্রকার আদর্শ তার উপর আরোপ করার। বরং সবধরনের সিদ্ধা,ন্ত শুধুমাত্র ব্যক্তির উপরই নির্ভরশীল এবং নিজের জন্য নেয়া ব্যক্তির যেকোনো সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা করা উচিত।

দার্শনিক ও মনঃস্তত্ববিদ থমাস জাস্জ আরেক প্রস্থ এগিয়ে বলছেন যে, আত্মহত্যার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর একটি। যদি স্বাধীনতার মানে হয় নিজস্বতার মালিকানা, নিজের জীবন ও শরীরের উপর মালিকানা, তবে একজন মানুষের নিজের জীবন ত্যাগ করার অধিকার তার সবচেয়ে বড় মৌলিক অধিকারগুলোর একটি। যদি অন্য কেউ একজন মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য করে, তবে মানুষটি তার নিজের জীবনের মালিক নয়, তার জীবন অন্যের কাছে বন্দী !

বিষয়: বিবিধ

৯৪৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File